অ্যানালাইসিস বিডি ডেস্ক
জালভোট, কেন্দ্রদখল, আগের রাতে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করাসহ ব্যাপক অনিয়মের মধ্য দিয়ে চলেছে সিলেট, বরিশাল ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। অসংখ্য কেন্দ্র থেকে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্য দলগুলোর এজেন্টদেরকে বের করে দেয়া হয়েছে। গত রাতেই রাজশাহীতে বিএনপির ২৪ জন এজেন্টকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিলেটে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে রাতেই ব্যালট বাক্স পূর্ণ করে ফেলা হয়েছে।
বরিশালে জাল ভোটের প্রতিবাদ করায় বাসদের মেয়র প্রার্থী ডাঃ মনিষা চক্রবর্তীর উপর হামলা করা হয়েছে। সিলেটে জামায়াতের মেয়রপ্রার্থী এহসানুল মাহবুব জুবায়েরের এজেন্টদেরকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। তিন সিটি থেকেই এমন অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে বরিশাল সিটিতে ভোট বর্জন করেছে বিএনপি। দুপুর পৌনে ১২টায় নগরীর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সারোয়ার। এসময় নির্বাচন কমিশনের কার্যালয় ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেয়া হয়।
‘রাতেই পূর্ণ ব্যালট বাক্স’
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী অভিযোগ করেছেন, রোববার রাতের আধারে ১০, ২০ ও ২১ নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন কেন্দ্রে ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া ২০ নং ওয়ার্ডে তার এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে এমসি কলেজ কেন্দ্রে বিএনপির কোনো এজেন্ট নেই।
তিনি বলেন, ‘আগে থেকেই যদি এভাবে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়, তবে আমরা কীভাবে মেনে নেব? তবে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকব। প্রয়োজনে শাহাদত বরণ করব। তবে পিছু হটব না।’
জামায়াত প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দরজা বন্ধ করে নৌকায় সিল
সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জামায়াত সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব অভিযোগ করেছেন, তার এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেছেন, ‘কেন্দ্র দখল করে নৌকায় ভোট দিচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। যার কারণে সিলেট সিটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা।’
জামায়াতের এই নেতা আরও জানান, ‘ভোট জালিয়াতির মাধ্যমে সিলেটের সম্প্রীতির ইতিহাসে কলঙ্কের কালেমা লেপন করছে আওয়ামী লীগ। সোমবার (৩০ জুলাই) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ২০নং ওয়ার্ডের এমসি কলেজ কেন্দ্র, ১১নং ওয়ার্ডের লামাবাজার কেন্দ্র ও ৭নং ওয়ার্ডের জালালাবাদ আবাসিক এলাকার দুটি কেন্দ্র ও কাজীরবাজার মাদ্রাসা কেন্দ্র থেকে টেবিল ঘড়ি মার্কার এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে। এসব কেন্দ্রে কক্ষগুলোর দরজা বন্ধ করে নৌকা প্রতীকে সিল মারা হচ্ছে।’
জাল ভোটের প্রতিবাদ করায় বরিশালে মেয়র প্রার্থী মনিষার উপর হামলা
বরিশালে কাউন্সিলর পদে কিছু ভোট হলেও মেয়র পদের ব্যালট দেয়া হচ্ছে না। জাল ভোটের প্রতিবাদ করায় বাসদের মেয়র প্রার্থী ডাঃ মনিষা চক্রবর্তীর উপর হামলা করা হয়েছে। বাসদ জেলা সভাপতি জানান, রিটার্নিং অফিসারের সামনে এ ঘটনা ঘটলেও কোন একশনে তিনি যাননি ।
জেলা বাসদ সভাপতি ইমরুল হাকিম রুমন মানবজমিনকে জানান, পৌনে ১০টার দিকে তারা তাদের মেয়র প্রার্থী ডাঃ মনিষা চক্রবর্তীসহ সদর গার্লস কেন্দ্রে জান। সেখানে তারা জানতে পারেন মেয়র ব্যালট বাদে অন্য ব্যালট দেয়া হচ্ছে। প্রার্থী ভিতরে গিয়ে দেখেন মেয়র ব্যালটে আওয়ামী লীগের কর্মীরা প্রকাশ্যে সিল মারছে। তিনি সাথে সাথে রিটার্নিং অফিসারকে সংবাদ দেন।
রিটার্নিং অফিসার দ্রুত চলে আসেন। এসময় তার সামনেই বাক বিতন্ডার এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের দুই কর্মী মনিষাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এ ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসারকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে অভিযোগ জানানোর চেষ্টা করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
মেয়রের ভোট দুপুরের পর’
বরিশালের কাশিপুরের ইছাকাঠি কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছেন গৃহবধু শারমিন আক্তার। জীবনের প্রথম ভোট। তাই উৎসাহ বেশি। ভোট কেন্দ্র থেকে ফিরে স্বামীকে জানালেন, কাকে কাউন্সিলর ভোট, কাকে সংরক্ষিত ভোট দিয়েছেন। প্রশ্ন করলেন স্বামী, মেয়র ভোট কাকে দিলা? স্ত্রীর উত্তর, মেয়র ভোটতো দুপুরের পর। আমাকে বলল এই দুইটা ব্যালট এখন দিন, দুপুরের পর মেয়র ভোট দেবেন। স্বামী সুমন জানান, তিনি কেন্দ্রেই যাবেন না।
২নং ওয়ার্ডে মোতালেব মিয়া বলেন, সকাল ৭টা থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। এখন পৌনে নয়টা বাজে। লাইনের ২/১ জন ঢুকছে ১৫/২০ মিনিট পরপর। অথচ ভিতরে একদল যুবক ঢুকছে আর বের হচ্ছে। পুলিশও কিছু বলছে না। আর আমরা লাইনে দাঁড়িয়েই আছি।
৪ নং ওয়ার্ডে পঞ্চাশোর্ধ এক ভদ্রলোক বলেন, এক ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। শেষ পর্যন্ত এলাকার ছোট এক ভাই বলল- দাদা বিকেলে আসেন। এখন অন্য কাজ চলছে।
‘আঙ্গুলে কালি লাগিয়ে ব্যালট নিয়ে গেছে নৌকার সমর্থকরা’
বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি কেন্দ্রে প্রকাশ্যে জাল ভোট প্রদানের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কেন্দ্রের ভেতর থেকে বের হয়ে বেশ কয়েজন ভোটার এমন অভিযোগ করেছেন।
ভোট দিতে পারেনি এমন এক ভোটার মনিরা ইসলাম বলেন, আজ নতুন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। আমার আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে অন্য একজন ভোট দিয়েছে। তিনি বলেন, ভোট দেয়ার জন্য সকাল থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু বুথের ভেতর গিয়ে আমার নিজের ভোট দিতে পারলাম না। আওয়ামী লীগ সমর্থকরা আমাকে ভোট দিতে দেয়নি। আঙ্গুলের কালি লাগিয়ে ব্যালট নিয়েছিলাম। কিন্তু আমার হাত থেকে ব্যালট নিয়ে তারা সিল দিয়েছে।
পুলিশের নেতৃত্বে সাংবাদিকদের ওপর চড়াও নৌকার সমর্থকরা
সিলেট সিটির শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কেন্দ্র থেকে সাংবাদিকদের বের করে দিয়েছে পুলিশ। বিএনপির অভিযোগ, কেন্দ্রের বাইরে মহড়া দিচ্ছে নৌকার সমর্থকরা। আর ভেতরে বুথ দখল করে জাল ভোট দিচ্ছে নৌকা সমর্থকরা। এ খবর পেয়ে ওই কেন্দ্রে গেলে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়।
জাল ভোটের ছবি তুললে ছাত্রলীগ কর্মীরা বাধা দেয়। তারা ক্যামেরা থেকে ছবি মুছে দিতে বলে। অন্যথায় মারধরের ভয় দেখায়। পুলিশের এসআই রহমতউল্লাহর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা উপস্থিত সাংবাদিকদের বের করে দেয়। সকাল এগারোটা থেকে ওই কেন্দ্রে এরকম অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
বরিশালে বিএনপির ভোট বর্জন, ইসি কার্যালয় ঘেরাওয়ের ঘোষণা
ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে বরিশাল সিটিতে ভোট বর্জন করেছে বিএনপি। দুপুর পৌনে ১২টায় নগরীর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সারোয়ার।
সংবাদ সম্মেলন থেকে নির্বাচন কমিশনের কার্যালয় ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেয়া হয়। এর আগে সকাল ১১টার দিকে জাল ভোটের অভিযোগে ভোট বর্জন করে ইসলামী আন্দোলন।
আজ সকাল থেকে বিএনপি বরিশালের বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটে অনিয়মের অভিযোগ করে আসছে। এজেন্টদের মারধর, কেন্দ্রে অবস্থান করতে না দেয়া, ব্যালট ছিনিয়ে নেয়াসহ নানা অভিযোগ আসে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে।
‘রাজশাহীতে বিএনপির ২৪ এজেন্ট নিখোঁজ’
বিএনপির চব্বিশ জন পোলিং এজেন্টকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নির্বাচনের ঠিক আগের দিন রোববার দুপুরে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। তিনি দুপুরে নির্বাচন কমিশনে আবারো অভিযোগ দিতে গিয়ে একথা বলেন।
এসময় তিনি বলেছিলেন, এই নির্বাচনকে বিএনপি আন্দোলন হিসেবে দেখছে। সোমবার বিএনপির নেতাকর্মীদের কাফনের কাপড় মাথায় বেধে ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য বিএনপি প্রস্তুত।
সিলেটে পাঠানটুলায় সংঘর্ষ, ভোটগ্রহণ বন্ধ
সিলেট নগরীর পাঠানটুলা এলাকায় শাহজালাল জামেয়া ইসলামিয়া কামিল (এমএ) মাদরাসা কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে সংর্ষের কারণে বেশ কিছু সময় ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। সকাল সোয়া ১১টার দিকে এ সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে ওই ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহণ বন্ধ রাখা হয়। পরে ভোটগ্রহণ শুরু হয়।
এর আগে সিলেটের শাহজালাল জামেয়া ইসলামীয়া কামিল (এমএ) মাদরাসা পাঠানটুলা কেন্দ্রে জামায়াত ও বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রোমানের নেতৃত্ব এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। বর্তমানে কেন্দ্রটি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
রাজশাহীতে ৩০ মিনিটে ৫৬ ভোট
রাজশাহী সিটিতে নির্বাচনী খবর সংগ্রহের সময় ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের হাতে এক সাংবাদিক লাঞ্ছিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগী সাংবাদিক নয়াদিগন্তের স্টাফ রিপোর্টার শামছুল ইসলাম জানান, সকাল থেকেই নগরীর ৩০ নং ওয়ার্ডের বিনোদপুর ইসলামীয়া কেন্দ্রে পোলিং এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছেনা এমন অভিযোগ আসে।
সরেজমিনে তিনি দেখতে পান, ওই কেন্দ্রে মাত্র আধা ঘন্টার মধ্যে মেয়র পদের ব্যালটে পড়েছে ৫৬টি ভোট। ব্যালটের কয়েকটি অবশিষ্ট অংশে (মুড়ি) দেখা যায়নি ভোট দাতার টিপসই বা স্বাক্ষর। যদিও ঐ বুথেই কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর ব্যালটে পড়েছে ২৫ ভোট। ওই কেন্দ্রের ঘুড়ি প্রতীকের এজেন্টদের আওয়ামীলীগ কর্মীরা চড় থাপ্পড় মেরে বের করে দেয়।
ঘটনাস্থলে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন থাকলেও তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। পোলিং অফিসারদের কাছে এর কারণ জানতে চাইলে স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা সাদ্দামের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত এই সাংবাদিক শামছুল ইসলামকে লাঞ্ছিত করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেন।